সংক্ষিপ্ত বিবরণঃ
বান্দরবান শহর থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে কেওকারাডং পর্বতের গা ঘেষে, রুমা উপজেলায় অবস্থিত রহস্যময় বগা লেক( boga lake bandarban )।নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি এই বগা লেক অনেক ভ্রমনপিপাসু মানুষের প্রিয় জায়গা। কিন্তু ক’জন জানেন যে এই বগা লেকের উৎপত্তি নিয়ে গা-শিউরানো রহস্যের কথা?
বগা লেকটির আশেপাশে ‘বম’ উপজাতির বসবাস। তাদের ভাষায়, এখন যেখানে বগা লেকটি রয়েছে, সেখানে আসলে একটি চোঙাকৃতির বিশাল পাহাড় ছিল। সবকিছু স্বাভাবিক ভাবেই চলছিল। তবে হঠাৎ করে একদিন পাহাড়ের পাসের গ্রামগুলো থেকে গরু, ছাগল থেকে শুরু করে এমনকি ছোট ছোট বাচ্চারাও হারিয়ে যেতে থাকলো। অনেক খোঁজাখুঁজি করে জানা গেল, বাচ্চাগুলোর ও গরুছাগলের সর্বশেষ পায়ের ছাপ রয়েছে ঐ পাহাড়ে। তখন সবাই ধারণা করতে শুরু করলো, নিশ্চয়ই ভয়ংকর কিছু একটি রয়েছে ঐ পাহাড়ের কোলে, আর সেটারই আক্রমণের শিকার হচ্ছে নিরীহ এই প্রাণী আর বাচ্চারা। একদল সাহসী যুবকদের আসল রহস্য উদঘাটন করতে দায়িত্ব দেয়া হয়। অনেক অনুসন্ধান করতে করতে পাহাড়ের মাথায় উঠে দেখতে পেল সেখানে একটি গুহায় আস্তানা গেড়েছে এক মস্ত বড় ড্রাগন। তাদের আর বুঝতে বাকি থাকলো না যে এতগুলো প্রাণী ও বাচ্চাগুলোর হারিয়ে যাওয়ার পিছনে এই ড্রাগনেরই হাত রয়েছে।
বম ভাষায় ড্রাগনকে ‘বগা’ বলা হয়।
গ্রামবাসীরা সিদ্ধান্ত নিল যে, যে করেই হোক এই ড্রাগনকে মেরে ফেলতে হবে। তারা বেছে বেছে সাহসী তরুণদের নিয়ে একটি দল তৈরি করলো। তীর, ধনুক, বল্লম, লাঠি আর মশাল নিয়ে রাতের অন্ধকারে তারা হানা দিল গুহায়। গুহার মেঝেতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মানুষের রক্ত আর হাড়গোড় দেখে তারা বুঝে নিল কী ঘটেছে। একসঙ্গে তারা সেই ড্রাগন অর্থাৎ বগার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। তুমুল যুদ্ধ হল দুই পক্ষের মধ্যে। লড়তে লড়তে বগার প্রাণবায়ু যখন প্রায় শেষ, তখন বগা তার মুখ থেকে আগুনের শিখা ছুঁড়ে মারে গ্রামবাসীর দিকে। সেই আগুন পুরো পাহাড়কে গ্রাস করে ফেলে। বিস্ফোরিত হতে শুরু করে চারিদিক। শুরু হয় ভূমিকম্প। ভূমিকম্পে সেই পাহাড়টি ভেঙে তৈরি হয় এক বিশাল গর্তের। সময়ের পরিক্রমায় সেই বিশাল গর্তটিই আজ আমাদের কাছে ‘বগা লেক’ নামে পরিচিত।
তবে এই পৌরাণিক কাহিনী মানতে নারাজ ভূতাত্বিকদের মতে, বগা লেক মৃত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ বা মহাশূন্য থেকে উল্কাপিণ্ডের পতনের কারণে এর সৃষ্টি।
বগা লেক-এর পানি অম্লধর্মী। জলজ প্রাণী গুলোকে এখানে প্রতিকূলতার সাথেই বেঁচে থাকতে হয় । বাইরের কোনো পানি এখানে ঢুকতেও পারে না, আবার এর আশপাশে নেই পানির কোনো দৃশ্যমান উৎস। তবে এটির ব্যাখাও দিয়েছেন ভূত্বাতিকরা। তারা বলেছেন, লেকটির তলদেশে একটি উষ্ণ ঝর্ণা রয়েছে। ঝর্ণা থেকে যখন পানি বের হয়, তখনই হ্রদের পানির রঙ বদলে যায়।
কিভাবে যাবেনঃ
ঢাকা থেকে বান্দরবান , বান্দরবান থেকে রুমা , রুমা থেকে বগালেক
কোথায় থাকবেনঃ
বগা লেকে ছোট ছোট কটেজ আছে। ভাড়া মাত্র ১০০ টাকা প্রতিরাত। কোন কটেজে ১ টি রুম, কোনটিতে ২টি। কিন্তু ভাড়া একই।যারা বান্দরবানে রাতে থাকবেন- হোটেল সাঙ্গুঃ ০১৫৫৬৫২৯৫৮৭ (৫০০ থেকে ১০০০ টাকা প্রতি রাত। দরাদরি করে নেবেন। হোটেলের মান খুব ভালো ) ।
হোটেল নিলগিরি: ০১৫৫৮৪২১৩১৯( ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা প্রতি রাত) ।
যা যা দেখবেনঃ
আকাশের কাছ থেকে একমুঠো নীল নিয়ে হ্রদ নিজেও ধারন করেছে বর্নিল রং। পাহাড়ের চূড়ায় নীল জলের আস্তর আকাশের সাথে মিশে তৈরি করেছে এক প্রাকৃতিক কোলাজ। মুগ্ধ নয়নে দেখতে হয় আকাশ, পাহাড় আর জলের মিতালী। প্রকৃতি এখানে ঢেলে দিয়েছে একরাশ সবুজের ছোঁয়া। দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে আসার ক্লান্তি হারিয়ে যায় বগা লেকের অতলগহ্বরে।
এ যেন সুন্দরের লীলাভূমি। বগা লেককে অনেকে ড্রাগন লেকও বলে থাকে। সকাল, সন্ধ্যা ও রাত-তিন বেলায় বগা লেক নতুন রূপে ধরা দেয়। সকালের উজ্জ্বল আলো যেমন বগা লেককে দেয় সিগ্ধ সতেজ রূপ। ঠিক তেমনি রাতের বেলায় দেখা যায় ভিন্ন এক মায়াবী হাতছানি। রাতের বগা লেক দিনের চেয়ে একেবারেই আলাদা। যদি রাতটি হয় পূর্ণিমার, তবে এটি হতে পারে আপনার জীবনের সেরা রাতের একটি। কি অসাধারণ সে রূপ। নিকষকালো অন্ধকার রাতে পাহাড়ের বুক চিরে হঠাৎ একফালি চাঁদ মৃদু আলোর ঝলক নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে বগা লেকের শান্ত জলে।
শান্ত জলের অপরূপ দৃশ্য দেখতে খানিকটা ভয়ঙ্কর পথ পাড়ি দিতে হবে আপনাকে!
ভয়ঙ্কর পথ! বড় বড় পাহাড় ধসে রাস্তা হারিয়ে গেছে, আর আমরা এইভাবে বেয়ে পথ চলেছি। ঠিক যেন টিকটিকির মতো! কোথাও কোথাও কোমর পর্যন্ত কাদা। সবার পেছনে ক্যামেরা হাতে ছবি তুলতে তুলতে আমিও ফেঁসে গেলাম! কাঁদায় ডেবে গেল হাঁটুর উপর পর্যন্ত। ডিসকভারির বাংলা ধারাভাষ্যের মতো আপদকালীন কর্মীর খোঁজ করছিলাম তখন! তবে শীতকালে এই রাস্তা অনেকটা নিরাপদ। একটু সচেতন হলেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে পথচলা যায়।
অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়দের বান্দরবান অ্যাডভেঞ্চার শুরু হয় মূলত বগা লেক দিয়ে। বগা লেকে রাত্রি যাপন করেনি এমন অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় পাওয়া দুস্কর। দেশের হিমালয়জয়ী সকল পর্বতারোহি বগা লেক দিয়ে তাদের পর্বতারোহন শুরু করেছিলো। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, মিথ ও অসাধারন থাকার জায়গা এখানকার মূল আকর্ষণ। দুর্গম এ অঞ্চলে যেতে হলে পথচলার কষ্ট সহ্য করার মতো মন-মানসিকতা থাকতে হবে। বিশেষ করে রুমা থেকে বগা লেক যাবার পথটি এবড়োথেবড়ো, যথেষ্ট উঠা-নামার পথ। আর গাড়িতে চলার সময় পাবেন ধুলা। তবে এ পথচলায় যে অ্যাডভেঞ্চার আছে, দেশের আর কোথাও পাবেন না!
বগালেক বান্দরবান শহর থেকে ৬০কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। বান্দরবান শহর হয়ে প্রথমে রুমা বাজার যেতে হবে। বান্দরবান থেকে রুমা বাজারের দূরত্ব ৪৮ কিলোমিটার। লোকাল বাস কিংবা চাঁন্দের গাড়ি/জীপে করে রুমা বাজার যাওয়া যায়। বাসে যেতে হলে বান্দরবানের রুমা বাস স্ট্যান্ডে যেতে হবে। সেখান থেকে ১ ঘন্টা পর পর বাস রুমার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। দলগত ভাবে গেলে রুমা বাজার যেতে পারেন জীপ/চান্দের গাড়িতে করে। এক গাড়ীতে ১৩জন যাওয়া যায়।
রুমা বাজার পৌঁছে বগালেক যাবার জন্য প্রথমে গাইড ঠিক করে নিতে হয়। অনুমোদিত যে কোনো গাইডকে নেয়া যায়। রওনা হবার আগে রুমা বাজার আর্মি ক্যাম্প থেকে বগা লেক যাবার অনুমতি নিতে হবে। অনুমতির জন্য ভ্রমণকারী সকল সদস্যের পরিচয় লিখিত কাগজে জমা দিতে হয়। এই কাজগুলো করতে গাইড সাহায্য করে থাকে। বিকেল ৪টার পর বগালেক যাবার অনুমতি দেয়া হয় না।
রুমাবাজার থেকে বগালেকের আগমহুর্তে কমলাবাজার পর্যন্ত যেতে পারবেন। কমলা বাজার নেমে, বাগালেক যেতে একটা পাহাড় উঠতে হবে। প্রায় ২৫ মিনিট পায়ে হেঁটে পাহাড়ে উঠার পরই আপনি বগালেকের দেখা পাবেন। বগালেক পৌঁছে সেখানের আর্মি ক্যাম্পে রিপোর্ট করতে হবে।