বারো বাজার | ঝিনাইদহ

সংক্ষিপ্ত বিবরনঃ

বারোবাজার( barobazar )যে একটি অতি প্রাচীন স্থান তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু কোন সময় নির্দেশক প্রমাণের অভাবে এ স্থানের সঠিক ইতিহাস নির্ধারণ করা কষ্টকর। স্যার ফানিংহাস এ স্থানের অনেক দক্ষিণে অবস্থিত মুরলীতে প্রাচীন সমতট রাজ্যের রাজধানী ছিল বলে অনুমান করেন। সতীশ বাবু ও আব্দুল জলিল এ মতের সমর্থক। “যশোরদ্য দেশ” নামক গ্রন্থে জনাব হোসেন উদ্দিন আরও অনেক ধাপ এগিয়ে এ স্থানকে গংগায়িত বা গংগা রাষ্ট্রের রাজধানী বলে মনে করেন। এ সমস্ত অভিমত সম্পূর্ণভাবে অনুমান ভিত্তিক এবং কোন নির্ভরযোগ্য প্রমাণের উপর প্রতিষ্ঠিত নয় তা বলা বাহুল্য।

খুব সম্ভব জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ শাহের আমলে এ স্থানে দরবেশ-শাসক উলুখ খান-ই জাহান খুব সম্ভব তাঁর সময়েই এস্থানে প্রথম মুসলিম অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেন। খান-ই-জাহান তাঁর সহচর ও সৈন্যবাহিনী নিয়ে বেশ কিছুদিন এখানে অবস্থান করেছিলেন বলে প্রবল জনপ্রবাদ আছে। তিনি খুব সম্ভব যুদ্ধ করে এ স্থান অধিকার করেছিলেন।

ঐতিহাসিক স্থান প্রবন্ধে জনাব হোসেন উদ্দীন হোসেন বলেন, “বারোবাজারে প্রথমে কোন মুসলমান পীর দরবেশ ধর্মপ্রচারে পদার্পণ করেছিলেন, ইতিহাসে তার কোন পরিচয় নেই, ইতিহাস এখানে নীরব হয়ে আছে। লোকমুখে এবং অনৈতিহাসিক পুঁথি মারফত আমরা যতটুকু জানতে পারি তাতে গাজী কালু ও উলুখ খান জাহান আলীর নাম বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ। এই সকল পুঁথি ও লোকগাঁথা শ্রবণ করে পরবর্তীকালে অনেকেই ইতিহাস রচনা করেছেন।”

“বারোবাজারে প্রাচীন আমলের অসংখ্য কীর্তি আজও মহাকালের শত আঘাত বিপর্যয়ের মধ্যে টিকে আছে। সাবেক আমলের প্রসত্মর খন্ড ছড়িয়ে আছে লুপ্ত নগরীর বুকের উপর। এখানে গাজীর নামে পরিচিত হয়ে আছে গাজীর জাংগাল। এই গাজীর জাংগাল ব্রাক্ষ্মণগড় হতে উৎপত্তি হয়ে সোজা বারোবাজারে এসে মিশেছিল।”

“প্রাচীন যুগের এই বর্ধিষ্ণু শহরটি কিভাবে ধবংসপ্রাপ্ত হয়েছিল তার কোন ইতিহাস নেই। তবে এখানকার মাটিতে যে অজস্র নরকংকাল মিশে আছে, তাতে সহজেই অনুমিত হয়, এই শহরে ব্যাপকভাবে মহামারী দেখা দিয়েছিল, নতুবা যুদ্ধের ভয়ংকর অভিশাপ নিয়ে অজস্র ঘোড়ার খুরে পদদলিত করে ভেংগে চুরমার করে দিয়েছিল এই শহরটি কোন দ্বিগ্বীজয়ী; তা-কে জানে? বারোবাজার আজ মৃতের নগরী।”

কথিত আছে বারোবাজার নামকরণ পীর খান জাহান আলীর প্রদত্ত। তাঁর সংগে এগারো জন অলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন সাধক এসেছিলেন। এই এগারোজন সাধকের নাম যথাক্রমে গরীব শাহ, বাহরাম শাহ, বুড়া খা, ফতে খা, পীর খা, মীর খা, চাঁদ খা, এক্তিয়ার খা, বক্তার খা, আলম খা প্রভৃতি। আবার জনশ্রুতির উপর ভিত্তি করে বলা হয়ে থাকে যে, খান-ই-জাহান বারোজন আউলিয়া নিয়ে এখানে প্রথমে এসেছিলেন এবং বারোজন আউলিয়া থেকে বারোবাজার নামকরণ হয়েছিল। এটি খুব সম্ভবতঃ একটি গল্প। খান-ই-জাহান ৩৬০ জন আউলিয়া ও ৬০,০০০ সৈন্য নিয়ে দক্ষিণ বংগে এসেছিলেন বলে লোকে বলে থাকে।

হোসেন উদ্দিন হোসেনের বর্ণনা অনুসারে- “বারোটি বাজার নিয়ে প্রসিদ্ধ ছিল প্রাচীন বারোবাজার। এই শহরের পরিধি ছিল ১০ বর্গমাইল। খোসালপুর, পিরোজপুর, বাদুরগাছা, সাদেকপুর, ইনায়েতপুর, মুরাদপুর, রহমতপুর, মোলস্নাডাংগা, বাদেডিহি, দৌলতপুর, সাতগাছি প্রভৃতি গ্রাম নিয়ে গড়ে উঠেছিল।

মুসলমান আমলে হয়তো এখানে একটি বড় বাজার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই বাজার থেকেই খুব সম্ভব বারোবাজার নাম হয়ে থাকবে। কেউ কেউ বলেন বারোজন আউলিয়ার নামানুসারে বারোবাজার নামকরণ হয়েছে।

এ প্রসংগে সম্প্রতি প্রকাশিত ‘যশোর জেলার ইতিহাস’ নামক গ্রন্থে যে বর্ণনা আছে তা নিম্নে দেওয়া হলো :-

“ভৈরব নদীর উত্তর তীরে অবস্থিত বারোবাজর একটি প্রাচীন স্থান। এস্থানে অসংখ্য প্রাচীন কীর্তির ধ্বংসাবশেষের চিহ্ন আজও দেখা যায়। ‘যশোহর খুলনার ইতিহাস’ নামক গ্রন্থে বাবু সতীশ চন্দ্র মিত্র বলেন যে, বারোবাজারের ৩/৪ মাইল বিস্তৃত স্থান ইষ্টক স্তুপে পরিপূর্ণ। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ১৯৬৯ সালের একটি অপ্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, ৩/৪ মাইল এলাকা জুড়ে এখানে বহু কীর্তির ধ্বংসাবশেষের অস্তিত্ব ছিল।”

এই শহরের পরিধি ছিল দশ বর্গমাইল। খ্রীষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে গংগায়িত রাজ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই গংগায়িত বা গংগা রাষ্ট্রের রাজধানী ছিল বারোবাজার।

কতকালের কত মানুষের ইতিহাস বুকে ধারণ করে আছে এই বারোবাজার। একদা এখানে গড়ে উঠেছিল একটি সুন্দর জনবহুল জনপদ। কালের বিবর্তনে আজ তার কোন চিহ্ন নেই। এখানে ওখানে নরকংকালের ছড়াছড়ি, আর প্রাচীন কয়েকটি দীঘি। মহাকালের গর্ভে সবই বিলীন হয়ে গেছে; শুধু সাক্ষী হয়ে বেঁচে আছে সেকালের কীর্তিরাজি।

কিভাবে যাবেনঃ

ঢাকা থেকে বারোবাজারঃ বারোবাজারের অবস্থান ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলায়, যশোরের ঠিক আগেই। যশোর খুলনাগামী বাস বারোবাজারে ভিতর দিয়েই যায়। কাজেই এই বাসগুলোতে উঠে পড়লেই হবে। তবে দক্ষিণবঙ্গ থেকে আসলে কালীগঞ্জ বা ঝিনাইদহের বাসগুলোতে বা সরাসরি ঢাকার বাসে উঠলেও হবে। ট্রেনে আসলে নামতে হবে কুষ্টিয়ায়, সেখান থেকে ৮০ টাকা বাস ভাড়ায় বারোবাজার। নয়তো যশোর, সেখান থেকে পেছনে ব্যাক করতে হবে। তবে কুষ্টিয়া নামাটাই ভাল। ঢাকা থেকে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ থানা, সেখান থেকে কাছেই বারোবাজার, ঝিনাইদহ-যশোর রোডের ওপর। মসজিদগুলো হাঁটার দূরত্বের মধ্যেই। রিকশা বা অটোয় আরেকটু এগুলেই গাজীকালু-চম্পাবতীর মাজার, আর তার অল্প দূরত্বে মল্লিকপুর গ্রামে বাজারের পাশেই বৃহত্তম সেই বটগাছ। লালন আর সিরাজ সাইয়ের জন্মস্থান অবশ্য পাশের হরিণাকুন্ডূ থানায়।

আপনার কোন প্রশ্ন থাকলে বা এই বিষয়ে কোন কিছু জানানোর থাকলে নীচের মন্তব্য বিভাগে লিখতে ভুলবেন না । আপনার ভ্রমণ পিয়াশি বন্ধুদের সাথে নিবন্ধটি শেয়ার করে নিন যাতে তারাও জানতে পারে ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *