শহীদ মিনার | নোয়াখালী

0
223

সংক্ষিপ্ত বিবরনঃ

সেদিন ছিল ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি( Shahid Minar )। কঠিন রাজনৈতিক অবস্থার মুখোমুখি থেকে ও আইয়ুবী শাসক গোষ্ঠির রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে জীবন বাজি রেখে সে সময় নোয়াখালী জেলার হাতেগোনা কয়েকজন স্কুলপড়ুয়া ছাত্র ও তরুণ মিলে এক অজপাড়াগাঁয়ে কাদামাটি দিয়ে শহীদ মিনার স্থাপন এবং শহীদদের স্মরণে পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্যদিয়ে প্রথম শহীদ দিবসটি পালন করেন। বেগমগঞ্জ হাইস্কুলের ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী কয়েকজন ছাত্র ‘নুরূল আমিনের কল্লা চাই’, ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’— ‘শহীদদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না’— এ শ্লোগান দিয়ে বৃহত্তর নোয়াখালী জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক কমরেড নুরুল হক চৌধুরী মেহেদীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক জিএম মরহুম আবদুল জলিল, টিএন্ডটি এসডিই মরহুম মোঃ হানিফ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা প্রয়াত শান্তি রঞ্জন কর্মকার ও চৌমুহনীর চক্ষু চিকিত্সক মরহুম আবুল খায়েরসহ আরো কয়েকজন কাজীর হাইস্কুলের মাঠে একুশের রাতে জড়ো হন। তারা সকলে মিলে কাজিরহাট হাইস্কুলের মাঠে কাদামাটি দিয়ে তৈরি করেন শহীদ মিনার। এটিই ছিল জেলার প্রথম শহীদ মিনার ও শহীদ দিবস পালন। সেদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তখনকার তরুণ ছাত্র ও আজকের বয়োবৃদ্ধ কমরেড মেহেদী আবেগাপ্লুত হয়ে স্মরণ করেন তার এক শিক্ষক মরহুম মাস্টার আবদুল করিমকে। এ শিক্ষকের অনুপ্রেরণায় তিনি ও তার সহপাঠিরা নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যদিয়ে প্রথম শহীদ মিনারটি স্থাপন করে শহীদ দিবস পালন করেছিলেন।

পরবর্তী সময়ে ১৯৬৯ সালে ইট-সিমেন্ট দিয়ে ঐ শহীদ মিনারটি স্থায়ীভাবে স্থাপন করা হয়েছিল। তিনবার স্থান পরিবর্তনের পর এটি কাজীরহাট শহীদ আমানউল্যাহ উচ্চ বিদ্যালয় সম্মুখে স্থায়ীভাবে স্থাপন করা হয়েছে। জেলার প্রবীণ রাজনীতিবিদ সাবেক এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক মোঃ হানিফ জানিয়েছেন, ‘৫২-‘৫৩ সালের দিকে কাজিরহাট এলাকার মানুষ রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত সচেতন ও সংগঠিত ছিল। সেজন্য সম্ভব হয়েছিল শহীদ মিনার তৈরি ও শহীদ দিবস পালন। চৌমুহনী কলেজের একসময়ের মেধাবী ছাত্র, সাবেক সচিব ও পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য মোঃ সিরাজউদ্দিন জানিয়েছেন, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির পর বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষায় প্রতিষ্ঠার দাবিতে ছাত্র-জনতাকে সংগঠিত করার জন্য চৌমুহনী কলেজের আইএ ২য় বর্ষ মানবিকের ছাত্র ফজলুল করিম চৌমুহনী বাজারে সমাবেশ করতে গিয়ে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। গ্রেফতারের পর তাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে একবছর বন্দী রাখা হয়। ‘৫৩ সালের শেষের দিকে তিনি মুক্তি পান। মরহুম ফজলুল করিম জেলায় ভাষা আন্দোলনকারীদের মধ্যে প্রথম একমাত্র গ্রেফতারকৃত ভাষা সৈনিক। তিনি পরে অধুনালুপ্ত দৈনিক বাংলা পত্রিকার ঢাকা সিটির প্রধান প্রতিবেদক ছিলেন।

অধ্যাপক মোঃ হানিফ আরো জানিয়েছেন, চৌমুহনী কলেজ ছাত্র সংসদ ১৯৬৩ সালে প্রথম জেলায় স্থায়ীভাবে ইট-সিমেন্ট দিয়ে শহীদ মিনার নির্মাণ করে শহীদ দিবস পালন করে। এ সময়ে ছাত্র সংসদের ভিপি মরহুম এডভোকেট কাজী মোঃ সোলায়মান, জিএস মোঃ গিয়াসউদ্দিন ও এজিএস মাহমুদুর রহমান বেলায়েত (সাবেক এমপি ও বৃহত্তর নোয়াখালীর বিএলএফ প্রধান) এবং মরহুম পাঠান সিদ্দিক, খালেদ মোহাম্মদ আলী (সাবেক এমপি), জাসদ নেতা আ.স.ম আবদুর রব সাবেক মন্ত্রী ও এডভোকেট জয়নাল আবেদিন প্রমুখ ছাত্র সংসদ ও ছাত্রনেতারা আইয়ুবি দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ভাষা সৈনিকদের স্মরণ ও বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা করার দাবিতে এক দুঃসাহসিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল।

১৯৫৪-৫৫ সালের মরহুম আলী আহামেদ ও কমরেড মেহেদী জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। সে সময় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তারা মূলত ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মী ছিলেন। পাশাপাশি এতে আওয়ামী লীগ ও ন্যাপের নেতাদের অগ্রণী ভূমিকা ছিল। আর জেলার রাজনৈতিক নেতৃত্বে ছিলেন সাবেক স্পীকার মরহুম জননেতা আবদুল মালেক উকিল। তার সাথে ছিলেন সাবেক এমপি মরহুম আবদুর রশিদ, মরহুম নুরুল হক এমএলএ, সাবেক এমএলএ মরহুম শহিদউদ্দিন এস্কেন্দার কচি, মরহুম গাজী আমীনউল্যাহ, মরহুম মাওলানা খালেদ সাইফুল্ল্যাহ ও রইসউদ্দিন প্রমুখ। মাহমুদুর রহমান বেলায়েত জানিয়েছেন, সে সময় ছাত্রনেতাদের মধ্যে ছিলেন মরহুম এডভোকেট মহিউদ্দিন মহি, আসম আবদুর রহমান, মরহুম শামসুজ্জামান চৌধুরী বাবুল, সাবেক এমপি ফজলে এলাহী, ঢাকা হাইকোর্টের এডভোকেট আসাদুল্লাহ বেলাল, মরহুম মুন্সি ফারুক ও আজিজুর রহমান ইকবাল।

মরহুম আবদুল মালেক উকিলের অনুপ্রেরণায় তারা স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে জেলা জজ আদালতের পার্শ্বে শহীদ মিনারটি স্থাপিত হয়। এ সময় ছাত্রনেতা আজিজুর রহমান ইকবালকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি গঠিত হয়। সে সময় ২১ ফেব্রুয়ারি উদযাপন কমিটির ব্যানারে সাতদিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার মধ্যদিয়ে জেলার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার পাদদেশে শহীদ দিবস পালিত হয়। ১৯৯২ সালে নভেম্বরে জেলা জজ আদালতের পার্শ্ববর্তী শিশুপার্কের এক কোণে নতুনভাবে বর্তমান কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারটি স্থানান্তর করা হয়।

আপনার কোন প্রশ্ন থাকলে বা এই বিষয়ে কোন কিছু জানানোর থাকলে নীচের মন্তব্য বিভাগে লিখতে ভুলবেন না । আপনার ভ্রমণ পিয়াশি বন্ধুদের সাথে নিবন্ধটি শেয়ার করে নিন যাতে তারাও জানতে পারে ।