সুন্দরবন ভ্রমণ | খুলনা

0
507

সংক্ষিপ্ত বিবরনঃ

সুন্দরবন( sundorbon tour khulna )হলো বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত একটি প্রশস্ত বনভূমি যা বিশ্বের প্রাকৃতিক বিস্ময়াবলীর অন্যতম। গঙ্গা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র নদীত্রয়ের অববাহিকার বদ্বীপ এলাকায় অবস্থিত এই অপরূপ বনভূমি বাংলাদেশের খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলা এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দুই জেলা উত্তর চব্বিশ পরগনা ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জুড়ে বিস্তৃত। সমুদ্র উপকূলবর্তী নোনা পরিবেশের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন হিসেবে সুন্দরবন বিশ্বের সর্ববৃহৎ অখণ্ড বনভূমি। ১০,০০০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে গড়ে ওঠা সুন্দরবনের ৬,০১৭ বর্গ কিলোমিটার রয়েছে বাংলাদেশে এবং বাকি অংশ রয়েছে ভারতের মধ্যে।

সুন্দরবন ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। এর বাংলাদেশ ও ভারতীয় অংশ বস্তুত একই নিরবচ্ছিন্ন ভূমিখণ্ডের সন্নিহিত অংশ হলেও ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় ভিন্ন ভিন্ন নামে সূচিবদ্ধ হয়েছে; যথাক্রমে “সুন্দরবন” ও “সুন্দরবন জাতীয় উদ্যান”নামে। সুন্দরবনকে জালের মত জড়িয়ে রয়েছে সামুদ্রিক স্রোতধারা, কাদা চর এবং ম্যানগ্রোভ বনভূমির লবণাক্ততাসহ ক্ষুদ্রায়তন দ্বীপমালা। মোট বনভূমির ৩১.১ শতাংশ, অর্থাৎ ১,৮৭৪ বর্গকিলোমিটার জুড়ে রয়েছে নদীনালা, খাঁড়ি, বিল মিলিয়ে জলাকীর্ণ অঞ্চল।বভূমিটি, স্বনামে বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার ছাড়াও নানান ধরণের পাখি, চিত্রা হরিণ, কুমির ও সাপসহ অসংখ্য প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত। জরিপ মোতাবেক ১০৬ বাঘ ও ১০০০০০ থেকে ১৫০০০০ চিত্রা হরিণ রয়েছে এখন সুন্দরবন এলাকায়। ১৯৯২ সালের ২১শে মে সুন্দরবন রামসার স্থান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। সুন্দরবনে প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক ঘুরতে আসে। দেশ-বিদেশের অসংখ্য পর্যটক সুন্দরবনের অপরূপ সৌন্দার্যে মুগ্ধ। সুন্দরবন ভিজিট করার মাধ্যমে তার প্রকৃতি থেকে বিভিন্ন জ্ঞান অর্জন করে।

নামকরণঃ

বাংলায় সুন্দরবন-এর আক্ষরিক অর্থ সুন্দর জঙ্গল বা সুন্দর বনভূমি। সুন্দরী গাছ থেকে সুন্দরবনের নামকরণ হয়ে থাকতে পারে, যা সেখানে প্রচুর জন্মায়। অন্যান্য সম্ভাব্য ব্যাখ্যা এরকম হতে পারে যে, এর নামকরণ হয়তো হয়েছে “সমুদ্র বন” বা “চন্দ্র-বান্ধে (বাঁধে)” (প্রাচীন আদিবাসী) থেকে। তবে সাধারণভাবে ধরে নেয়া হয় যে সুন্দরী গাছ থেকেই সুন্দরবনের নামকরণ হয়েছে।

কিভাবে যাবেনঃ
ঢাকা থেকে সুন্দরবন যেতে চাইলে সরাসরি বাসে খুলনা যেতে হবে। এছাড়া ট্রেন ও প্লেনেও খুলনা যাওয়া যায়। ঢাকার কমলাপুর থেকে খুলনার ট্রেনে উঠে খুলনা শহরে যেতে পারবেন। প্লেনে যেতে হলে যশোর নামতে হবে। যশোর থেকে বাস অথবা গাড়ী ভাড়া করে খুলনা যাওয়া যায়। খুলনা শহরে অনেক আবাসিক হোটেল রয়েছে। সেখানে রাতে অবস্থান করে পরের দিন সকালে সুন্দরবন যেতে হবে। এজন্য আপনাকে প্রথম যেতে হবে মংলা। খুলনা থেকে প্রাইভেট গাড়ি অথবা বাসে মংলা যাওয়া যায়। দূরত্ব ৫০ কিলোমিটার। মংলা ঘাট থেকে ট্রলার কিংবা লঞ্চে যেতে হবে সুন্দরবন। মংলা ঘাট থেকে সুন্দরবনের করমজল যেতে সময় লাগে দুই ঘন্টা। সকালে খুলনা থেকে মংলা হয়ে সুন্দরবন ঘুরে সন্ধ্যার মধ্যে আবার খুলনা ফিরে আসা যায়। এছাড়া খুলনা স্টিমার ঘাট থেকে সকালে সরাসরি সুন্দরবন লঞ্চ ছেড়ে যায়। এগুলো বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্সির। তাদের কাছ থেকে আগে টিকিট কেটে রাখতে হবে।

কি খাবেনঃ
দেশে মধু উৎপাদনের অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র হচ্ছে সুন্দরবন। ১৮৬০ সাল থেকে সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ করা হয়। বনসংলগ্ন একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী বংশপরম্পরায় মধু সংগ্রহ করে। এদেরকেই মৌয়াল বলা হয়। দেশে উৎপাদিত মোট মধুর ২০% সুন্দরবনে পাওয়া যায়। সুন্দরবনের সবচেয়ে ভালো মানের মধু খোলসী ফুলের ‘পদ্ম মধু’। মানের দিক থেকে এরপরেই গরান ও গর্জন ফুলের ‘বালিহার মধু’। মৌসুমের একেবারে শেষে আসা কেওড়া ও গেওয়া ফুলের মধু অপেক্ষাকৃত কম সুস্বাদু।মধু সংগ্রহের জন্য প্রতিবছরের ১ এপ্রিল থেকে তিন মাসের (এপ্রিল, মে ও জুন) জন্য বন বিভাগ মৌয়ালদের অনুমতিপত্র (পাস) দেয়। আর সময় নষ্ট না করে শুরুর দিন থেকেই মধু সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে মৌয়ালরা।মধু সংগ্রহ করতে যাওয়ার আগে বিশেষ প্রার্থনা করে নেন মৌয়ালরা ৷ কারণ সেখানে বাঘের ভয়ের পাশাপাশি আছে ডাকাতের ভয় ৷ কেউ কেউ পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যান৷ মধু সংগ্রহের কিছু নিয়মনীতি ঠিক করে দিয়েছে বন বিভাগ, যেমন- মৌচাক থেকে মৌমাছি সরানোর সময় আগুনের ধোঁয়া ব্যবহার করতে হবে –এরকম নিয়ম আছে৷

কোথায় থাকবেন
সুন্দরবনের অভয়ারণ্যে হিরণ পয়েন্টের নীলকমল এবং টাইগার পয়েন্টের কচিখালী ও কটকায় বন বিভাগের রেস্টহাউজে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। ভাড়া নীলকমলে দেশি পর্যটকদের জন্য প্রতি কক্ষ ৩ হাজার টাকা, ৪ কক্ষ ১২ হাজার টাকা। কচিখালী প্রতি কক্ষ ৩ হাজার টাকা, ৪ কক্ষ ১০ হাজার টাকা। কটকা প্রতি কক্ষ ২ হাজার টাকা, ২ কক্ষ ৪ হাজার টাকা। বিদেশিদের কাছে ভাড়া কিন্তু প্রায় দ্বিগুণ। সুন্দরবনের পাশে সাতক্ষীরা শহরে সাধারণ মানের হোটেল ও শ্যামনগরের মুন্সিগঞ্জে এনজিও সুশীলনের রেস্টহাউস ও ডরমেটরিতে একক, পরিবার ও গ্রুপ নিয়ে থাকার সুবিধা রয়েছে। মংলায় আছে পর্যটন কর্পোরেশনের হোটেল, পশুর বন্দরে সাধারণ হোটেল আছে পর্যটকদের থাকার জন্য। খুলনা মহানগরে হোটেল রয়েল, ক্যাসেল সালাম, হোটেল টাইগার গার্ডেন, হোটেল ওয়েস্ট ইন্, হোটেল সিটি ইন, হোটেল মিলিনিয়াম মানসম্পন্ন।

দেখার মত কি কি আছেঃ
কটকাঃ
সুন্দরবনের অন্যতম সুন্দর এলাকা এই কটকা। দলবেঁধে চলা হরিণের পাল দেখার সেরা জায়গা এটি। আর যেখানেই খাবার, সেখানেই খাদক-অর্থাৎ হরিণ শিকারের আশায় বসে থাকে বাঘ। তবে ভাগ্য প্রসন্ন হলে তবেই দেখা মিলবে বাঘের। খুলনা শহর থেকে ১৫০ কিলোমিটার এবং মংলা থেকে ১০০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত কটকা। এখানে যেতে হলে ট্যুর অপারেটর ধরেই যেতে হবে।

কচিখালীঃ
সমুদ্র যাদের টানে, তাদের জন্য সেরা গন্তব্য কচিখালী। কটকা থেকে ১৪ কিলোমিটার পূর্ব দিকে এই সমুদ্রতীরে হেঁটে বা নৌযানে করে যাওয়া যেতে পারে। দূষণমুক্ত নির্জন সমুদ্রতটই এখানকার মূল আকর্ষণ। সেই সঙ্গে রাতের বেলায় জোনাকি, ছায়াপথ আর পানিতে ফ্লুরোসেন্ট প্ল্যাংকটন মিলে আলোছায়ার অদ্ভুত খেলা শুরু করে। আর সে সময়ে নৌকায় করে ঘোরার অনুভূতিটাই অন্য রকম। হরিণ, কুমির, বানর আর বাঘ এখানকার অন্যতম আকর্ষণ।

নীলকমলঃ
সুন্দরবনের দক্ষিণাঞ্চলের এই জায়গাকে অনেকে হিরণ পয়েন্টও বলে থাকেন। মংলা থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে এই স্পট। এখানকার মূল আকর্ষণ রাজগোখরা, ভোঁদড়, হরিণ আর বাঘ।

মান্দারবাড়িয়াঃ
মান্দারবাড়িয়া সুন্দরবনের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। দুবলার চর বা নীলকমল থেকে খুব সহজেই নৌপথে এখানে যাওয়া যায়। বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হওয়ার সুবাদে নির্জনতা এখানকার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এখানে সামুদ্রিক কাছিম শীতে ডিম পেড়ে যায়। ইরাবতী ডলফিন, বোতলনাক ডলফিন, শুশুক ফাড়াও, রাজগোখরা, রাজকাঁকড়াসহ অন্যান্য কাঁকড়া।

দুবলারঃ
চর কটকা থেকে ২৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে দুবলার চর নামের এই জেলেদ্বীপের অবস্থান। নানা প্রজাতির মাছ আর কাঁকড়া পাওয়া যায় এখানে। নভেম্বর মাসের পূর্ণিমায় রাশমেলা হয় এই দ্বীপেই। দ্বীপে বাস করা জেলেদের কার্যক্রম দেখতেও অনেকে এই দ্বীপে যান।

করমজলঃ
সুন্দরবনে ঢোকার অন্যতম পথ। মংলা সমুদ্রবন্দর থেকে মাত্র ৪৫ মিনিটের নৌপথ। যাদের হাতে সময় নেই, তাদের জন্য বেশ ভালো স্পট করমজল, কারণ আধা বেলা ঘুরেই গোটা সুন্দরবন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় এখান থেকে। বেড়াতে খরচ হবে সর্বোচ্চ দুই হাজার টাকা। সুন্দরবন যেহেতু পুরোটাই ম্যানগ্রোভ, করমজলও এর ব্যতিক্রম নয়। করমজল যাওয়ার পথে দেখা যাবে শুশুকের ডিগবাজি। কাঠের ট্রেইল ধরে পুরো এলাকা ঘুরে বেড়ানো এখানকার অন্যতম আকর্ষণ। এখানে লোনা পানির কুমির ও হরিণ প্রজননকেন্দ্রও রয়েছে। খুলনা থেকে এক দিনে ঘুরে খুলনায় ফেরত যাওয়া সম্ভব বলে এখানে পর্যটকরা বেশি আসে।

হাড়বেড়িয়াঃ
খুব ভোরে যদি বেরিয়ে পড়তে পারেন মংলা থেকে রূপসা নদী ধরে, তবে হাড়বেড়িয়া ফরেস্ট স্টেশন পর্যন্ত ঘুরে আসতে পারবেন দিনে দিনেই। খরচ হবে সর্বোচ্চ ছয় হাজার টাকা। হরিণ আর বানরের দল দেখা যাবে নিশ্চিত। ভাগ্য প্রসন্ন থাকলে দেখা মিলতে পারে মায়া হরিণেরও। আর নানা প্রজাতির পাখি তো রয়েছেই। এ ছাড়া সম্প্রতি শুশুক, ইরাবতী ডলফিন, কালিকাইট্টা কচ্ছপ, কালামুখ প্যারাপাখি ও ভোঁদড় রক্ষার জন্য তিনটি নতুন অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয়েছে।

ঢাংমারী বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য ও চাঁদপাই বন্য প্রাণী অভয়ারণ্যঃ
ঢাংমারী খাল থেকে ঘাগরামারী টহল ফাঁড়ি পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ১২ কিলোমিটার নৌপথ এবং এর আশপাশের জঙ্গলকে এই অভয়ারণ্যের আওতায় আনা হয়েছে। পশুর নদীর খানিকটা অংশ ও করমজল টহল ফাঁড়ির ছিু অংশও এই অভয়ারণ্যের সীমানায় পড়েছে। আর নন্দবালা টহল ফাঁড়ি, চাঁদপাই রেঞ্জ অফিস, আন্ধারমানিক টহল ফাঁড়ির মধ্যবর্তী জায়গা নিয়ে চাঁদপাই বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য। ঢাংমারী ও চাঁদপাই যাওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো মংলা থেকে মোটরসাইকেল ভাড়া করে সেখানে যাওয়া।

দুধমুখী বন্য প্রাণী অভয়ারণ্যঃ
দুধমুখী টহল ফাঁড়ি আর সুপতি রেঞ্জ অফিসের মধ্যবর্তী ভোলা নদী ও বেতমারী নদীর কিছু অংশ নিয়ে দুধমুখী বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য। বাগেরহাটের শরণখোলা থেকে মোটরসাইকেল ভাড়া করেই এই অভয়ারণ্য ঘুরে বেড়ানো যায়।

আপনার কোন প্রশ্ন থাকলে বা এই বিষয়ে কোন কিছু জানানোর থাকলে নীচের মন্তব্য বিভাগে লিখতে ভুলবেন না । আপনার ভ্রমণ পিয়াশি বন্ধুদের সাথে নিবন্ধটি শেয়ার করে নিন যাতে তারাও জানতে পারে ।